হাইলাকান্দি, ১৮ সেপ্টেম্বর : ১৮টি গ্রহাণু চিহ্নিত করল “অ্যাস্ট্রোজেন”। আট সদস্যের শিলচরের সিটিজেন সায়েন্স গ্রুপের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এ-অঞ্চলে বিজ্ঞান চর্চার এক নতুন সাফল্য।
তবে বিস্ময়কর ঘটনা হল, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হিমাদ্রি শেখর দাসের নেতৃত্বাধীন এই অ্যস্ট্রোজেন গ্রুপে রয়েছে মাত্র বছর এগারোর এক সদস্যা দলের সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্যা হল ঐশী জ্যোতি।
ক্ষুদে এই বিজ্ঞানী এর মধ্যে একাই ক্ষুদ্র দুটি গ্রহ (গ্রহাণু) শনাক্ত করেছে।
শিলচরের ডনবস্কো স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ঐশী হিমাদ্রিবাবুরই কন্যা। আটজনের এই দলটি রয়েছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের গবেষক গুলাফসা বেগম চৌধুরি, দুই ছাত্রী সঞ্চালী নাথ মজুমদার ও তনুশ্রী ভট্টাচার্য, শিলচরের গুরুচরণ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের দুই ছাত্র সৈকত মজুমদার ও আকাশদীপ মহন্ত এবং দিল্লির সিটিজেন সায়েন্টিস্ট শোভন আচার্য।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সার্চ কোলাবরেশনের চারটি ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেই ‘অ্যাস্ট্রোজেন’-এর এই সাফল্য এসেছে।
এই ক্যাম্পেইনের সঙ্গে অবশ্য যুক্ত রয়েছে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা-ও। ভারত সহ বিশ্বের নানা দেশের সিটিজেন সায়েন্টিস্টরা এই ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
‘সিটিজেন সায়েন্স’ হল সেই বিষয় যেখানে সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানীদের মতোই, তবে স্বাধীনভাবে, কাজ করেন বা তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ করে পেশাদার বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা করে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে হাজারো নাগরিক বিজ্ঞান গবেষণা প্রকল্প চলছে। এই প্রকল্পগুলি বিভিন্ন বিষয়ের হয়ে থাকে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, জিওগ্রাফি, মেডিসিন, জেনেটিক্স থেকে শুরু করে অ্যাস্ট্রোনমি, ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইকোলজি এবং আরও অনেক কিছু।
এসবের মধ্যে গ্রহাণু আবিষ্কার অভিযান হচ্ছে একটি জনপ্রিয় সিটিজেন সায়েন্স প্রজেক্ট। এটি পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সার্চ কোলাবরেশন। এটি একটি নাগরিক বিজ্ঞান প্রোগ্রাম যা বিশ্বব্যাপী নাগরিক বিজ্ঞানীদের উচ্চ মানের জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য সরবরাহ করে।
কোনো খরচ ছাড়াই এই সেবা নাগরিক বিজ্ঞানীদের প্রদান করা হয়! আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের প্যানোরামিক সার্ভে টেলিস্কোপ এবং র্যাপিড রেসপন্স সিস্টেম এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত।
মূলত পেন-স্টার্স থেকে তোলা রাতের আকাশের বিভিন্ন ছবি নাগরিক বিজ্ঞানীদের দেওয়া হয়। আর এর থেকেই ‘অ্যাস্ট্রোমেট্রিকা’ সফটওয়ারের মাধ্যমেই নাগরিক বিজ্ঞানীরা গ্রহাণু শনাক্ত করে থাকেন।
প্রতি মাসে প্রায় ২৫ দিন ধরে চলে এই ক্যাম্পেন। এখন পর্যন্ত ১০,১৯০ টি গ্রহাণুকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছেন এই নাগরিক বিজ্ঞানীরা।
সৌরজগতের সব থেকে বড় গ্রহ বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় (প্রায় ৫৫ কোটি কিলোমিটার) অতি ক্ষুদ্র গ্রহের মতো কিছু বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে; তাদের বলা হয় গ্রহাণু।
এই এলাকাটাকে ‘অ্যাস্টরয়েড বেল্ট’ বলা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলো সৃষ্টি হওয়ার সময় মঙ্গল ও বৃহস্পতির গ্রহের মধ্যবর্তী অঞ্চলে আরও একটি গ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পরিস্থিতি ছিল, কিন্তু কিছু কারণে সেখানে কোনও গ্রহ সৃষ্টি হতে পারেনি। আর তাই সেখানে অবস্থান করছে লক্ষ কোটি বিভিন্ন আকারের গ্রহাণু।
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় গ্রহাণু হল সিরেজ। এটির ব্যাস হচ্ছে ৯৪৫ কিলোমিটার। কিছু কিছু গ্রহাণু সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর খুব পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় যাদের ‘নিয়ার আর্থ অ্যাস্টরয়েডস্’ বলা হয়।
অতীতে এমন কয়েকটি গ্রহাণু পৃথিবীতেও এসে পতিত হয়েছিল যার ফলে হয়েছে বিপুল ক্ষতি। বিজ্ঞানীদের একটি অংশের মতে, অতীতে ধূমকেতু বা গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের জন্যই ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটেছিল।
এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯০০০টি ‘নিয়ার আর্থ অ্যাস্টরয়েডস্’ এবং বিভিন্ন আকারের প্রায় ৬ লক্ষ গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে।
অধ্যাপক ড. হিমাদ্রি শেখর দাস বিষয়টি নিয়ে বলেন, বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যেই ‘অ্যাস্ট্রোজেন’ সিটিজেন সায়েন্স গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। এটির আবার রয়েছে ফেসবুক পেজ।
জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে তাঁরাই সিটিজেন সায়েন্সের বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ক্যাম্পেইন শেষ হলেই মিলবে ‘আইএএসসি’-র তরফ থেকে শংসাপত্র যাতে নাসার নামও থাকবে।
ভবিষ্যতে এই সার্টিফিকেট ছাত্রছাত্রীদের কেরিয়ার গড়ার কাজেও লাগতে পারে, বলেন আবি-র এই অধ্যাপক।
অ্যাস্ট্রোজেনকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন ‘এসএ সিটিজেন সায়েন্স গ্রুপ’-এর টিম লিডার শোভন আচার্য। ক্যাম্পেন থেকে প্রাপ্ত রাতের আকাশের বিভিন্ন অঞ্চলের একগুচ্ছ ছবি সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
তারপর সদস্যরা সেই ছবিগুলো সফটওয়ারের মাধ্যমে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে গ্রহাণু শনাক্ত করেন। চলতি বছরের ২৯ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল প্রথম ক্যাম্পেন। চতুর্থ ক্যাম্পেন শেষ হয়েছে গত ১৬ সেপ্টেম্বর।
এই ১৮ টি আবিষ্কৃত গ্রহাণুর মধ্যে হিমাদ্রিবাবু ৪ টি, ঐশী ২ টি, তনুশ্রী ৬ টি, সঞ্চালি ২টি এবং বাকি সদস্য শোভন, গুলাফসা, আকাশদীপ এবং সৈকত ১টি করে গ্রহাণু শনাক্ত করেছেন।
তবে এককভাবে আবিষ্কার করলেও তা কিন্তু দলগতভাবে ‘মাইনর প্ল্যানেট সেন্টারে’ রিপোর্ট করা হয় এটাই সিটিজেন সায়েন্স গ্রুপের নিয়ম।
এছাড়া সদস্য হিসেবে গ্রুপে ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের গবেষক ভাস্কর গোস্বামী ও একই বিভাগের ছাত্রী অনামিকা পাল, এবং গুরুচরণ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র সপ্তদ্বীপ সেন এবং সৌনক ভট্টাচার্য।
আপাতত এই আবিষ্কৃত গ্রহাণুগুলিকে প্রাথমিক শনাক্তকরণের তালিকায় রাখা হয়েছে। তারপর মাইনর প্ল্যানেট সেন্টারের বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্ত ফলাফল জানাবেন।
এটা জরুরি নয় যে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা একটি মহাজাগতিক বস্তু গ্রহাণু হবে। এই আনুষ্ঠানিকতায় লেগে যায় তিন থেকে চার বছর। তারপর আবিষ্কৃত বস্তুকে ‘প্রভিশনাল ডিটেকশন’-এর তালিকায় রাখা হয়। জানা গেছে, আগামীতে এমন আরও নানা ক্যাম্পেইনেই অংশ নেবে অ্যাস্ট্রোজেন।