বিশেষ প্রতিবেদন : স্ত্রী রিনিকি ভূইয়া শর্মার সাথে সম্পর্কিত জমি এবং ভর্তুকি কেলেঙ্কারীর সূত্র ধরে ফের আলোচনায় ওঠে এল আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পূর্ববের বিভিন্ন দুর্নীতি কর্মকাণ্ড।
কংগ্রেসে থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তকে লুই বার্জার এবং সারদা কেলেঙ্কারি জন্য একাধিকবার তাকে ইডি এবং সিবি আই-এর মুখোমগখিও হতে হয়েছিল।
এমনকি সেই সময়ের দার্জিলিং-এর সাংসদ তথা বিজেপির প্রথম সারির নেতা আলুওয়ালিয়া আসামের দুর্নীতিবাজ রাজনিতিকদের তালিকায় হিমন্তের নাম এক নম্বরে রেখে ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে তাকে তাকে তিহার জেলে পাঠানো হবে।
কিন্তু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের সাথে সাথে বিজেপির প্রতিশ্রুতিও বদলে যায়।
২০১৫ সালে হিমন্ত বিজেপিতে যোগদান করেন, দল তাকে সুরক্ষা দেয়। এরপর থেকে আর তাকে সিবিআই বা ইডি-র মুখোমুখি হতে হয়নি।
এখন তিনি ভারতের স্বচ্চতাবাদি দল বিজেপির এক নম্বর নেতা হওয়ার সাথে সাথে আসামের মুখ্যমন্ত্রী।
লুইস বার্জার ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেটেড একটি নিউ জার্সি-ভিত্তিক নির্মাণ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি।
কোম্পানি একটি মার্কিন আদালতকে বলেছিল, গুয়াহাটিতে একটি জল সরবরাহ প্রকল্পের জন্য ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে।
মার্কিন আদালতের নথি থেকে সেই সময় জানা গিয়েছিল ফার্ম এবং বেশ কয়েকটি কনসোর্টিয়াম অংশীদার আসামের গোয়া এবং গুয়াহাটিতে দুটি জল প্রকল্পের জন্য নয় লক্ষ, ছিয়াত্তর হাজার, ছয় শত উঞ্চল্লিশ ডলার ঘুষ দিয়েছে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সেই সময় গুয়াহাটি উন্নয়ন বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন এবং জল সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়নে নোডাল বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।
সিবিআই তদন্ত শুরু করলেও খুব বেশি এগোতে পারেনি, কারণ জিএমডিএ অফিস থেকে প্রকল্প সম্পর্কিত সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হারিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে হিমন্ত বিজেপিতে যোগদান করেন।
আসাম কংগ্রেস সভাপতি ভূপেন বরা বলেছেন, হিমন্ত বিশ্বর বেশ কয়েকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। জেলে যাওয়ার ভয়েই তাকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিতে হয়েছে।
একই ভাবে সারদা কেলেঙ্কারিও ছিল একটি প্রধান রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি।
সারদা গ্রুপের চেয়ারম্যান সুদীপ্ত সেন তার ১৮ পাতার স্বীকারোক্তিমূলক চিঠিতে সিবিআইকে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নাম দিয়েছেন।
সুদীপ্ত লিখেছে আরেকজন উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি আমাকে নাটকীয়ভাবে প্রতারণা করেছে, তিনি হলেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।
এই চিঠি পাওয়ার পর সিবিআই ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার গুয়াহাটি বাসভবন এবং নিউজ লাইভের অফিসে অভিযান চালায়।
তার স্ত্রী রিনিকি ভূইয়ান সরমার মালিকানাধীন একটি অসমীয়া সংবাদ চ্যানেল। সিবিআই হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে প্রায় আট ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল।
সেই সময় হিমন্ত এটিকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে করে বলেছিলেন তার নাম পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিতে যোগদানের পর এই তদন্তও ধামাচাপা পরে যায়, আর এগোয়নি।
এছাড়াও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার উপর রয়েছে চাঁদাবাজি, অস্ত্র আইনের মামলা, হত্যার, পিপিই কিটস কেলেঙ্কারি এবং ফ্লাইওভার কেলেঙ্কারির অভিযোগ।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে গুয়াহাটি শহরের চাঁদমারি এবং পানবাজার থানায় ১৯৯১ সালে পৃথক পৃথক মামলা হয়, যার নম্বর হল ৭৭/১৯৯১ ও ১৫/১৯৯১।
চাঁদমারী থানায় মামলাটি নথিভুক্ত করা হয় উলফার পক্ষ থেকে তিনি চাঁদাবাজি করছিলেন।
সেই সময় চাঁদাবাজির দশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করার সময় রক্ত হাতে তিনি ধরা পড়েছিলেন বলে অভিযোগ। ১৯৯১ সালের মার্চে টাডা ধারার অধীনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে উলফার পক্ষে একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগে টাদা-র অধীনে হিমন্তের বিরুদ্ধে পানবাজার থানায় মামলায করা হয়।
এই অপরাধে তিনি ১৫ দিনের পুলিশ হেফাজতেও ছিলেন।
অস্ত্র আইনের ধারায়ও পানবাজার থানায় হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে মামলা নতিভুক্ত করা হয়, একটি রিভলবার এবং ২৫ রাউন্ড গোলাবারুদ রাখার অভিযোগে মামলাও নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
গৌহাটি হাইকোর্ট আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে নথিভুক্ত দুটি টাডা মামলার নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।
সেই সময় হিমন্ত রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন।
বিহারের প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ সুখদেও পাসোয়ানের দায়ের করা একটি পিআইএল মামলার শুনানির পর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সমন্বয়ে গঠিত তিন জনের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুটি টাডা মামলা সম্পর্কিত কেস ডায়েরি হারিয়ে যাওয়ায় গৌহাটি হাইকোর্ট পরে উভয় ক্ষেত্রেই হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে খালাস দেয় কারণ৷
এরপর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিহত কংগ্রেস নেতা মানবেন্দ্র শর্মার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ২০১৯ সালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার কারণে আসু থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
মহন্ত আরও অভিযোগ করেছিলেন শর্মা নিজেকে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর সাইকিয়ার সাহায্য চেয়েছিলেন।
কোভিডের সময় ২০২০ সালে স্বাস্থ্য বিভাগ এক একটি পিপিই কিটের মূল্য ৯৯০ টাকা ধার্য করে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার স্ত্রীর সংস্থাকে জরুরি কাজের আদেশ দিয়েছিল।
সেই সময় হিমন্ত আসামের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং আদেশের মাত্র একটি অংশ স্বাস্থ্য বিভাগকে যা সরবরাহ করে অর্থ হাপিসের অভিযোগ ওঠে।
যদিও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাঁর স্ত্রী রিনিকি ভূঁইয়া শর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এছাড়া গুয়াহাটিতে একটি ফ্লাইওভার কেলেঙ্কারিতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নাম জড়ায়।
এই ফ্লাইওভারটি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর উদ্বোধন করেছিলেন, যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খরচ দেকান হয়েছিল ৪৫ লক্ষ টাকা।
কিন্তু এই ফ্লাইওভারটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের প্রায় পাঁচ মাস পর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং সাত মাস পর ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
যে ফার্মটিকে চুক্তিটি দেওয়া হয়েছিল তাও হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পরিবারের সাথে যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে।
দরপত্রের বিজ্ঞাপন স্থানীয় দৈনিকে ২০২২ সালের ৯ মার্চ প্রকাশিত হয়েছিল যা উদ্বোধনের প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় পরে।
এই দরপত্রে গুয়াহাটি ভিত্তিক দুটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেএমকে কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লাইয়ার, ড্রিমস এ মেজ এবং অঞ্জন শর্মা নামের একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছিল।
কিন্তু এক অদ্ভুত কাকতালীয়ভাবে তিনজন দরদাতা একই এলাকার একই ঠিকানাটি উদ্ধৃত করেছেন, কামাখ্যা ধাম, গুয়াহাটি।
পূর্তদপ্ত কাজের বরাত দিয়েছে মেসার্স ড্রিম এ মেজ কে, সংস্থাটির মালিক ছিলেন গুয়াহাটি ভিত্তিক ব্যবসায়ী ভাস্কর শর্মা।